রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে টানা চারদিন ধরে সকল চিকিৎসা সেবা বন্ধ। চিকিৎসা না পেয়ে দুই শতাধিক রোগী ইতিমধ্যে হাসপাতাল ছেড়ে চলেগেছেন। তবে গুরুতর অসুস্থ ২৯ জন রোগী এখনও অনিশ্চিত অবস্থায় হাসপাতালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে রয়েছেন। তাদের অনেকের চোখ অপারেশন হয়েছে, আবার কাউকে অপরেশনের জন্য প্রস্তুতি করে রাখা হয়েছে। তবে কেউ চিকিৎসকের দেখা পাচ্ছেন না। সবচেয়ে বড় দুর্দশায় আছেন অপারেশন করা রোগীরা। তাদের অপারেশন পরবর্তী চিকিৎসা হচ্ছে না, এর মধ্যে তারা দুই দিন হাসপাতাল থেকে কোন খাবার পাননি। এই অনিশ্চয়তা কবে শেষ হবে তাও জানেন না রোগীরা।
আজ শনিবার বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সরজমিনে শেরেবাংলা নগরে হাসপাতাল গিয়ে দেখাগেছে, র্যাব, পুলিশ ও আনসারের কড়া পাহারা। প্রধান ফটকে তিনজন আনসার ফটক বন্ধ করে পাহারা দিচ্ছেন, ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। এরপরই হাসপাতালের মূল ভবন, সেই ভবনের ফটকের সামনে আনসার, পুলিশ ও র্যাবের পাহারা। হাসপাতালটির নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন আনসারের প্লাটুন কমান্ডার মো. শাহ আলম। তিনি আজকের বলেন, গত বুধবার হাসপাতালে কর্মচারি ও জুলাইয়ে আহতদের সংঘর্ষের পর সকল সেবা কার্যক্রম বন্ধ।
হাসপাতালটি গত চারদিনে ভুঁতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি তলার বিভিন্ন জায়গায় ময়লা, আবর্জনার স্তুপ দেখাগেছে। রোগীদের বিছানার কাপড় এদিকে সেদিকে পড়ে আছে, তাতে মাছি ভনভন করছে। কিছুকিছু তলায় অন্ধকার ও গা ছমছম অবস্থা।
হাসপাতালটিতে একসঙ্গে আড়াইশর বেশি রোগী সবসময় ভর্তি থাকেন। তবে এখন আছেন মাত্র ২৯ জন। এরমধ্যে চার তলায় পুরুষ ওয়ার্ডে এখনো গুরুতর অসুস্থ ২৫ জন রোগী রয়েছেন, যাদের অনেকেই চোখে দেখতে পান না। তাদের কারও অর্ধেক চিকিৎসা হয়েছে, কাউকে অপারেশন করে রাখা হয়েছে, কারও অপরাশনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। এসকল অসুস্থ মানুষ হাসপাতালে থাকবেন, নাকি চলে যাবেন, তাই তারা বুঝতে পারছেন না। কারণ হাসপাতালে কোন কর্মচারি ও চিকিৎসককে পাচ্ছেন না তারা। কয়কেজনকে অপারেশন করে রাখা হয়েছে, তারা পরবর্তী চিকিৎসা পাচ্ছেন না, তারা আছেন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। তাদেরই একজন কাওসার আহম্মেদ। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লাহ থেকে তিনি গত মঙ্গলবার হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসেন। তার চোখের রেটিনা অপারেশন হয়েছে। চতুর্থ তলার পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। অপরাশেন পরবর্তী চিকিৎসা হচ্ছে না তার। অপারেশনের পর তিনি এখন দুশ্চিন্তায় রয়েছেন, তিনি সুস্থ হবেন, নাকি আরও অসুস্থ হয়ে পরবেন। তিনি বলেন, অপারেশনের পর প্রতিদিন ইনজেকশন দেওয়ার কথা কিন্তু তা দেওয়া হচ্ছে না। এই অবস্থায় কি করবো বুঝতেছি না।
হাসপাতালটির পুরুষ ওয়ার্ডে এরকম আরও কয়েকজন তাদের দুর্ভোগের কথা বলেন। চট্টগ্রামের পটিয়ে থেকে সুলতানা আক্তার তার ১৩ বছরের ছেলে মনিরুল ইসলামকে নিয়ে গত ২২ দিন ধরে ভর্তি। চোখের বায়োপসি পরীক্ষা করতে দিয়েছেন, কিন্তু চারদিন ধরে চিকিৎসক না আসায় তিনি পরেছেন দুশ্চিন্তায়। এরমধ্যে অন্তত দিন দিন হাসপাতালের খাবার সরবরাহ বন্ধ ছিল। এই মা বলেন, তার বাড়ি এতো দূরে, তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না।
হাসপাতালটিতে বর্তমানে এরকম ২৯ জন রোগী রয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৫ জন পুরুষ ওয়ার্ডে, তিনজন নীচ তলায় পোস্ট অপারেটিভে এবং একজন শিশু কেবিন ব্লকে রয়েছেন। হাসপাতালে কেবল একজন লিফট ম্যান ও একজন বাবুর্চি আছেন। এছাড়া কেউ নেই। দুদিন খাবার বন্ধ থাকার পর শেরেবাংলা থানা কর্তৃপক্ষ বাবুর্চিকে খবর দিয়ে এনে শুক্রবার বিকেল থেকে খাবার সরবরাহ করার চেষ্টা করছেন। এছাড়া হাসপাতালে কেউ নেই।
চিকিৎসক-নার্স ছাড়া পরিবেশে দিশেহারা রোগীদের ছিল হাহাকার। হাসপাতালটির বিভিন্ন ওয়ার্ডের নার্সের টেবিলে রোগীদের ফাইলের স্তুপ দেখাগেছে। এসব রোগীরা চলেগেলেও তাদের ফাইল পরে আছে।
অপরদিকে, চতুর্থ তলার পূর্বপাশের স্পেশালাইজড ব্লকে জুলাইয়ে আহত ৬৬ জন এখনো ভর্তি রয়েছেন। যদিও তারা সংঘর্ষের সময় ৫৫ জন ছিলেন। শনিবার গিয়ে তাদের ওয়ার্ডে দেখা গেছে। তাদেরই একজন কোরবান হোসাইন। ছয় মাস ধরে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। তাঁর চোখে শর্টগানের গুলি লাগে, তিনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ না। তিনি বলেন, গত বুধবার আমাদের ওপর প্রথমে হাসপাতালের কর্মচারীরা হামলা চালায়। এরপর সংঘর্ষ হয়। তিনি সংঘর্ষে আহত হন।
জুলাইয়ে আহত আরেকজন আবির আহম্মেদ শরীফ। তিনিও এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি বলেন, ‘আমাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বাহিরে পাঠানোর ব্যবস্থা কেন করা হচ্ছে না। এখানে চিকিৎসা নেওয়াতে তো আমরা সুস্থ হচ্ছি না। আমাদের বিদেশে রেফার্ড করুক। চিকিৎসকেরা কেন আমাদের বিদেশে পাঠানোর কথা বলছে না।’
অচলাবস্থা কাটাতে শুক্রবার হাসপাতালের কয়েকজন সচিব, হাসপাতাল প্রতিনিধি, ছাত্র প্রতিনিধিসহ বৈঠক হলেও সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি তারা। রুবেল নামে একজন বলেন, ‘হাসপাতালেই আছি। সব ধরনের সেবা কার্যক্রম বন্ধ আছে। আমাদের খাবার ও ওষুধ বাইরে থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে।’
জুলাইয়ে আহতরা গতকাল হাসপাতালটির পরিচালকসহ সাতজনকে অপরসানের দাবি জানিয়েছে। এর মধ্যে হাসপাতালটির পরিচালক ডা. খায়ের আহমেদকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডা. জানে আলমকে।
গতকাল সন্ধ্যায় ডা. খায়ের আহমেদ বলেন, তিনি ছুটিতে আছেন। আর ফিরবেন না। এ সময় তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এদিকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলম বলেন, চিকিৎসা সেবা চালু করতে সব ধরণের চেষ্টা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ চলছে। মন্ত্রণালয়ও চেষ্টা করছে।
গত ২৫ মে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত চার রোগী বিষপান করলে প্রথম উত্তেজনার সূত্রপাত হয়। বুধবার হাসপাতালে ভর্তি আন্দোলনকারী, কর্মচারী এবং রোগীদের সঙ্গে থাকা স্বজনদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়।