নতুন নির্মিত রেললাইন থেকে চুরি হচ্ছে সংকেত (সিগন্যাল) ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম। বিশেষ করে আখাউড়া-লাকসাম ও ঢাকা-যশোর রেলপথে এগুলো চুরি বাড়ছে। এতে সংকেতব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ছে। চলতি মাসেই একটি ট্রেনের ইঞ্জিন ও লাগেজ বগি লাইনচ্যুত হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আখাউড়া-লাকসাম ও ঢাকা-যশোর রেললাইনে স্থাপিত আধুনিক সংকেতব্যবস্থার তামার কেব্ল, পয়েন্ট মেশিনের কেব্ল, সিগন্যাল পোস্টের লেডার, সিগন্যাল আসপেক্ট, কন্ট্রোল বক্সসহ সরঞ্জাম নিয়মিত চুরি হচ্ছে। এতে সংকেতব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায় ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণ এবং সংকেত আদান-প্রদান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটি ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, সিগন্যালিং সরঞ্জাম চুরি হলে ট্রেনের নিরাপত্তায় বড় ঝুঁকি তৈরি হয়। সঠিক সংকেত না পেলে চালক বিভ্রান্ত হতে পারেন, এতে সংঘর্ষ বা লাইনচ্যুতির আশঙ্কা থাকে। পাশাপাশি সময়মতো ট্রেন পরিচালনা ব্যাহত হয়, যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ে এবং পুরো রেলব্যবস্থায় অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এই চুরি রোধে রেলওয়ের কঠোর নজরদারি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তা জরুরি।
রেলওয়ের সিগন্যালিং বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সরঞ্জাম চুরি যাওয়ায় স্বয়ংক্রিয় সংকেতব্যবস্থা অনেক জায়গায় কাজ করে না। সেসব স্থানে ম্যানুয়ালি সংকেত দিতে হচ্ছে। অনেক সময় ট্রেন ধীরগতিতে বা থেমে থেমে চলায় যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প দপ্তর সূত্র জানায়, সংকেতের কারণে ৯ মে ঢাকা- যশোর রেললাইনের ফরিদপুরের ভাঙ্গা রেলওয়ে জংশনের এক কিলোমিটারের মধ্যে জাহানবাদ এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন ও লাগেজ বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে নতুন রেললাইনেরও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। ট্রেনটি যাত্রাবিরতি শেষে রাত ৯টা ২০ মিনিটের পর জংশন থেকে বের হয়ে সাড়ে ৯টার দিকে দুর্ঘটনায় পড়ে।
ওই দপ্তর সূত্র বলেছে, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেললাইন বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়ার পর সিগন্যালিংসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম চুরি হচ্ছে। এই পথের সব স্টেশন চালু না হওয়ায় এবং লোকবল না থাকায় চুরি হচ্ছে বেশি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই রেলপথের জন্য প্রয়োজনীয় ১ হাজার ৬৮০টি পদ সৃষ্টির অনুমোদন দেয়নি।
আখাউড়া-লাকসাম রেললাইনের সরঞ্জাম চুরির বিষয়ে অতিরিক্ত প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী (পূর্ব) কার্যালয় থেকে সম্প্রতি আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইনের প্রকল্প দপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেললাইন প্রকল্পের আওতায় সেকশন-১ এলাকায় স্থাপিত সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি বারবার চুরি হচ্ছে। ফলে সিগন্যাল বিকলতা বাড়ছে এবং ট্রেন চলাচলে বিলম্ব ঘটছে। পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের ব্যস্ত রুটে এ ধরনের চুরি ট্রেন চলাচলে চরম ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে এবং রেলওয়েকে আর্থিক ক্ষতিতে ফেলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী তারেক মোহাম্মদ সামছ তুষার পত্রিকাকে বলেন, সিগন্যাল সরঞ্জাম নিয়মিত চুরি হচ্ছে। পাশাপাশি রেললাইনের ক্লিপও চুরি হচ্ছে। পুলিশ প্যাট্রলিং ছাড়া এসব ঠেকানো সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো দেশে রেললাইনে মানুষের চলাচল নেই, কিন্তু এ দেশে রেললাইনে মানুষ অবাধে চলাফেরা করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি সিগন্যাল পোস্টে থাকা নির্দিষ্ট কিছু সরঞ্জাম ট্রেন চলাচলের নিরাপত্তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো চুরি হওয়ায় ট্রেন পরিচালনায় ম্যানুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করতে হচ্ছে, যা ঝুঁকিপূর্ণ ও অকার্যকর। আখাউড়া-লাকসাম-সিলেট রেলপথ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে হওয়ায় সেখানে মাদকসেবী ও অসাধু চক্রের অবাধ বিচরণ রয়েছে। তারা রেললাইনের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে মূল্যবান সরঞ্জাম চুরি করে এবং বিভিন্ন সময় সংকেতব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করে। পণ্য চোরাচালানে সুবিধার জন্য ট্রেনকে নির্ধারিত স্থান ছাড়া হঠাৎ থামানোর উদ্দেশ্যে তারা এই ঘটনা ঘটাচ্ছে।
রেল কর্মকর্তাদের অভিযোগ, রেললাইনের মালামাল চুরি করছে স্থানীয় লোকজন। এই চুরি ট্রেন চলাচলে ঝুঁকি তৈরি করছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, পুরোনো ও নতুন রেললাইনে চুরি হচ্ছে। সিগন্যালিং যন্ত্রপাতি চুরি রোধে খাঁচার মতো কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে, যাতে সহজে খুলতে না পারে। এসব সরঞ্জাম দেখভালের দায়িত্ব সিগন্যাল ও টেলিকম বিভাগের। চুরির ঘটনায় তারা এফআইআর করলে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) এসব ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। শত শত স্টেশনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী দেওয়া সম্ভব নয়, লোকবলের অভাব রয়েছে। পাহারাদার দিলেও তাঁরা একটু সরে গেলেই চুরি হয়।