ইসরায়েলের উদারপন্থী দৈনিক হারেৎজ চলতি সপ্তাহে এক শিরোনামে স্পষ্টভাবে বলেছে: ‘কূটনৈতিক সুনামি আসছে’। এই শিরোনামে সংবাদমাধ্যমটি মূলত সতর্ক করেছে। কারণ, গাজায় ইসরায়েলের ‘চূড়ান্ত উন্মত্ততা’র বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে ইউরোপ।
চলতি সপ্তাহে নানা রূপে কূটনৈতিক আক্রমণ এসেছে, যার সবগুলো সম্পর্কে আগাম অনুমানও করা যায়নি।
গাজায় ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলের নিন্দা থেকে শুরু করে ওয়াশিংটনে দুই তরুণ ইসরায়েলি দূতাবাসকর্মীর হত্যাকাণ্ড—সব মিলিয়ে দেশটি একটি উত্তাল সপ্তাহ পার করেছে।
গত সোমবার সন্ধ্যায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা গাজায় ইসরায়েলের ‘ভয়াবহ’ কার্যকলাপের নিন্দা জানিয়ে একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়ার পর থেকেই এই আক্রমণের ঢেউ ইসরায়েলের উপকূলে আছড়ে পড়তে শুরু করে।
ওই তিন দেশ সতর্ক করে বলেছে, ইসরায়েল যদি সামরিক অভিযান চালিয়ে যায় এবং মানবিক সহায়তার ওপর বিধিনিষেধ তুলে না নেয়, তাহলে তারা ‘আরও কঠোর পদক্ষেপ’ নিতে পারে। এ ছাড়া অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় ‘নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা’ দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে দেশগুলো।
এরপর ২৪টি দাতাদেশের একটি বিবৃতি আসে। এতে গাজার জন্য ইসরায়েল-সমর্থিত নতুন ত্রাণ সরবরাহ ব্যবস্থার নিন্দা জানানো হয়।
কিন্তু এটি ছিল কেবল শুরু।
পরদিন মঙ্গলবার যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করে এবং জানায়, ২০২৩ সালের ভবিষ্যৎ সহযোগিতার পথনকশা পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
এর মধ্যেই ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পশ্চিম তীরের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ড্যানিয়েলা ওয়েইসও ওই নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছেন। তিনি লুই থেরুর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র দ্য সেটলার্স-এ স্থান পেয়েছিলেন।
লন্ডনে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত তসিপি হোটোভেলিকে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরে তলব করা হয়েছে—এ ধরনের পদক্ষেপ সাধারণত রাশিয়া বা ইরানের মতো দেশের প্রতিনিধিদের ক্ষেত্রেই নেওয়া হয়ে থাকে।
ইসরায়েলের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তোলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কায়া কাল্লাসের বক্তব্য। তিনি বলেন, ইইউর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদেশ ইসরায়েলের সঙ্গে ২৫ বছরের পুরোনো সহযোগিতা চুক্তি পর্যালোচনা করার পক্ষে।
‘অনেক হয়েছে আর নয়’
ইসরায়েলের প্রতি অব্যাহত কূটনৈতিক নিন্দার কারণ অনেকটাই স্পষ্ট।
ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে গাজার বাসিন্দারা গণ-অনাহারের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, যার প্রমাণ বিশ্বজুড়ে ভীতিকর প্রতিক্রিয়া ছড়াচ্ছে।
ইসরায়েলের সামরিক অভিযান এবং চারপাশের কথাবার্তা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বিপর্যস্ত এই ভূখণ্ডে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে চলেছে।
গত মঙ্গলবার পার্লামেন্টের সদস্যদের উদ্দেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি ইসরায়েলের কট্টরপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচের একটি মন্তব্য উল্লেখ করেন। এই মন্ত্রী গাজায় ‘নিধন চালানো’, ‘যা বাকি আছে তা ধ্বংস করা’ এবং সেখানকার বেসামরিক জনগণকে অন্য কোনো দেশে স্থানান্তরের কথা বলেছিলেন।
ল্যামি বলেন, ‘যা বলা দরকার, আমাদের সেটাই বলতে হবে। এটি উগ্রপন্থা। এটি বিপজ্জনক, জঘন্য ও বিকৃত। তীব্র ভাষায় আমি এর নিন্দা জানাই।’
গাজায় যুদ্ধ পরিচালনার বিষয়ে স্মোত্রিচ নীতিনির্ধারক নন। এর আগে হলে তাঁর উসকানিমূলক মন্তব্য উপেক্ষা করা যেত। কিন্তু এখন সেই সময় আর নেই। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এখন তাঁর কট্টর-ডানপন্থী সহকর্মীদের প্রভাবাধীন বলেই মনে হচ্ছে। তবে এ কথা সঠিক হতে পারে, আবার ভুলও হতে পারে।
সমালোচকেরা অভিযোগ করছেন, নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের বেসামরিক মানুষের জীবন বা গাজায় এখনো আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের কথা না ভেবেই অব্যাহতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
যেসব দেশ এত দিন ধরে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে ছিল, তারাও এখন বলতে শুরু করেছে, ‘অনেক হয়েছে, আর নয়।’
এই সপ্তাহটি স্পষ্টতই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি ইসরায়েলের একজন দৃঢ় সমর্থক (তিনি একবার বলেছিলেন ‘আমি নিঃশর্তভাবে ইহুদিবাদকে সমর্থন করি’) এবং গত বছর গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে দ্বিধা করায় নিজ দল লেবার পার্টির ভেতর থেকেই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনিই গত মঙ্গলবার বলেছেন, গাজায় নিরীহ শিশুদের দুর্ভোগ ‘কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না।’
অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর দেশের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের এমন ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের মুখে নেতানিয়াহু ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা হামাসকে সমর্থন দিচ্ছে।
নেতানিয়াহু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে লিখেছেন, ‘যদি গণহত্যাকারী, ধর্ষক, শিশু হত্যাকারী ও অপহরণকারীরা আপনাকে ধন্যবাদ জানায়, তবে আপনি ন্যায়ের পথে নেই। আপনি মানবতার বিপরীতে এবং ইতিহাসের ভুল পাশে অবস্থান করছেন।’
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সার আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, গত বুধবার রাতে ওয়াশিংটনে জুইশ মিউজিয়ামের বাইরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ইসরায়েলি দূতাবাসকর্মী ইয়ারন লিসচিনস্কি ও সারা লিন মিলগ্রিমের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইসরায়েলবিরোধী সমালোচকদের ‘সরাসরি সংযোগ’ রয়েছে।
এই হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্বজুড়ে সহানুভূতির ঢল নামলেও ইসরায়েলি সরকার ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়ছে। কারণ, পশ্চিমা মিত্রদেশ ও ইহুদি জাতিগোষ্ঠীর বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও গাজা যুদ্ধ নিয়ে ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করছেন।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাবেক দূত ও টনি ব্লেয়ারের উপদেষ্টা ছিলেন লর্ড লেভি। তিনি বলেন, বর্তমান ইসরায়েল সরকারের সমালোচনাকে সমর্থন করেন। এমনকি এসব সমালোচনা আগে করা দরকার ছিল বলে মনে করছেন তিনি।
লর্ড লেভি নিজেকে একজন গর্বিত ইহুদি দাবি করেন এবং ইসরায়েলের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসাও প্রকাশ করেন। তিনি বিবিসি রেডিও ৪-এর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাট ওয়ান’ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘গাজায় যা ঘটছে, তার বিরুদ্ধে শুধু আমাদের নয়, আন্তর্জাতিকভাবে সবাইকে অবস্থান নিতে হবে।’
তবে সবকিছুর মধ্যেও একজন মানুষ সম্পূর্ণ নীরব—যিনি চাইলে এই যুদ্ধ থামাতে পারতেন। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সম্প্রতি উপসাগরীয় অঞ্চল সফর শেষে ট্রাম্প শুধু বলেছেন, ‘অনেক মানুষ অনাহারে আছেন।’
হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই যুদ্ধ নিয়ে হতাশ এবং ইসরায়েল সরকারকে যুদ্ধ ‘শেষ করতে’ বলছেন।
কিন্তু যখন অন্য পশ্চিমা নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, তখন ট্রাম্প প্রায় কিছুই বলছেন না।