বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারতের বাণিজ্য নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান সংকট তৈরি হয়েছে। রাজ্যের সীমান্ত জেলাগুলো সরবরাহ ব্যবস্থা ও জীবিকা সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
ভারতের স্থলবন্দর হয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানিতে আকস্মিক নিষেধাজ্ঞার কারণে সরবরাহ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। সীমান্ত শহরগুলো কার্যত জনশূন্য হয়ে গেছে এবং সীমান্ত বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার পরিবারের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন নীতি কার্যকর হয়েছে চলতি বছরের মে থেকে। এই নীতি অনুযায়ী, বাংলাদেশের পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য পেট্রাপোল, হিলি, মাহাদিপুর, চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ীর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অর্থনীতির জন্য এই বন্দরগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন থেকে এই ধরনের সব আমদানি কলকাতা ও নব সেবা সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এর ফলে, পশ্চিমবঙ্গে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ বাণিজ্য পথগুলো বাইপাস হয়ে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোল হয়ে ভারত-বাংলাদেশ স্থলভিত্তিক বাণিজ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবাহিত হয়। এই বন্দর হয়ে দৈনিক ট্রাক চলাচল এক সপ্তাহের মধ্যে ৬০০-৭০০ থেকে কমে ২০০ এর নিচে নেমে এসেছে। এর ফলে অনেক দোকানদারকে গ্রাহকের অভাবে দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হতে হয়েছে। আনুমানিক ২০০০-৩০০০ শ্রমিকের জীবিকা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এসব শ্রমিকের দৈনিক ৩০০-৬০০ রুপি।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪-পরগনার পেট্রাপোল স্থলবন্দরে সামির বিশ্বাস দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে পেট্রাপোল বন্দরে পণ্য লোড-আনলোড করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তাঁর দৈনিক আয় নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি শিগগির স্বাভাবিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা শুনছি যে, বাংলাদেশে নির্বাচনের পর পরিস্থিতি বদলাতে পারে, কিন্তু এখানে কী হবে কে জানে। আমি এখন অটোরিকশা চালানো শুরু করেছি। আর কত দিন বসে থাকব?’
বনগাঁও উত্তরের বিজেপি বিধায়ক অশোক কীর্তনীয়া মন্তব্য করেছেন, ‘এটা সত্যি যে, স্থলভিত্তিক আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখানকার অনেক গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সীমান্ত এলাকায় পরিবহন একটি বড় ব্যবসা এবং রাজ্য সরকার স্লট-বুকিং নীতি চালু করে এরই মধ্যে এর ক্ষতি করেছে। তবে আমি মনে করি দেশের স্বার্থে এই কষ্ট মেনে নিতে হবে।’
পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপক আন্তসীমান্ত সরবরাহ ব্যবস্থার প্রায় ৭০ শতাংশই ছোট পরিবহন অপারেটরদের মালিকানাধীন এবং এরা সবাই বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত। এই গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দরগুলোতে দৈনিক ট্রাক চলাচল তীব্রভাবে কমে যাওয়ায় আনুমানিক ১২ থেকে ১৫ হাজার শ্রমিক তাদের আয়ের প্রধান উৎস হারানোর দ্বারপ্রান্তে। এর মধ্যে রয়েছে দিনমজুর, ট্রাকচালক, লোডার এবং বিভিন্ন আনুষঙ্গিক পরিষেবা প্রদানকারী।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) অনুসারে, বাংলাদেশের ভারতে রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ বেনাপোল স্থলবন্দরের মাধ্যমে যায় এবং এর বেশির ভাগই প্রধানত পোশাক। গত ১০ মাসে স্থলপথে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারণ (স্থলপথের পরিবর্তে সমুদ্রপথে) শিপিংয়ে ৩ দিনের পরিবর্তে দুই সপ্তাহ লাগতে পারে, যা খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ বিশ্বজিৎ হালদার বলেন, ‘বাংলাদেশ বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হবে, তবে তাদের বুনন শিল্পও ভারত থেকে কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। চাহিদা কমে যাওয়ায় ভারতীয় উৎপাদকরাও উৎপাদন কমিয়ে দেবে, যার ফলে এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। দরিদ্র সীমান্ত কর্মীদের আয় কমে যাওয়ায় স্থানীয় ভোগ হ্রাস পাবে, যা আঞ্চলিক অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে।’
বস্ত্রের ঐতিহ্যবাহী প্রবাহ—যেখানে ভারতীয় তুলা ও সুতা বাংলাদেশে পোশাক তৈরির জন্য পাঠানো হতো এবং তারপর ভারতের বৃহৎ বাজারের জন্য পুনরায় আমদানি করা হতো তৈরি পোশাক—নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাহত হয়েছে। দুর্গাপূজা মৌসুম (সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অক্টোবরের শুরু) ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে, খুচরা বিক্রেতারা আশঙ্কা করছেন যে—চাহিদা সরবরাহের চেয়ে বেশি হবে, যার ফলে গ্রামীণ বাজারে সাশ্রয়ী মূল্যের পোশাকের ঘাটতি দেখা দেবে।
কলকাতার বড় বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী সুরেন্দ্র গুপ্ত খেদ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের বাজারে, এমনকি দিল্লি ও মুম্বাইয়ের মতো বড় শহরগুলোতেও কিছু সাশ্রয়ী মূল্যের পোশাক পাওয়া যেত, যা বাংলাদেশ থেকে আসত। সেই পুরো অংশটি এখন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
হাওড়া হাটের ব্যবসায়ী শেখ সোহেল বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে এমন দামে পণ্য আসত, যা দরিদ্র মানুষ কিনতে পারত। এই পোশাকগুলো নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য একটি লাইফলাইন ছিল। সেগুলো এখনো এখানে পাওয়া যায়, তবে একটু বেশি দামে। বারমুডা শর্টস এবং সস্তা মহিলাদের পোশাকের মতো জিনিস সেখান থেকে আসত।’
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চালানের জন্য ভারতীয় স্থলপথের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল। বাংলাদেশ প্রতি বছর ভারতে আনুমানিক ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে, যার প্রায় ৯৩ শতাংশই ঐতিহ্যগতভাবে স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করত। পোশাক প্রস্তুতকারকেরাও সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং নতুন লজিস্টিকসের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে তিন মাসের বিলম্বের অনুরোধ করেছেন।