প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) চরম দায়িত্ব অবহেলার খেসারত দিতে হচ্ছে ৪০৪ উন্নয়ন প্রকল্পকে। এসব প্রকল্পে অর্থছাড় ও খরচে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। এর আগে পরিকল্পনা কমিশন থেকে এগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তাব দেওয়া হয় এনইসি বৈঠকে। কেননা আগামী জুন মাসেই চলমান এই প্রকল্পগুলোর মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো এগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধি কিংবা সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় বিশেষ ‘তারকা’ চিহ্ন দিয়ে আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) যুক্ত করা হয়েছে। রোববার এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ এসব প্রকল্পের বোঝা চাপছে নতুন এডিপির ঘাড়ে। এতে ভবিষ্যতে প্রকল্পগুলোর ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এসব প্রকল্পের বিষয়ে ক্লিয়ারকাট একটি নির্দেশনা থাকা দরকার। কেননা বছরের পর বছর একই ঘটনা ঘটবে আর কোনো জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে না- এটা হতে পারে না। প্রকল্পের সংশোধন বা মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে অবশ্যই প্রকল্প পরিচালকদের গাফিলতি আছে। এক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেরি হওয়ার পেছনে কিন্তু শুধু প্রকল্প পরিচালকরা দায়ী নন। এর পেছনে থাকে নানা কারণ। যেমন সময়মতো অর্থছাড় হয় না, ঠিকাদাররা পালিয়ে যায় ও গাফিলতি করে এবং ক্লাইমেটসংক্রান্ত কিছু বিষয়সহ নানা বিষয় যুক্ত থাকে। শেষ পর্যন্ত দায় চাপে জনগণের ওপর। মেয়াদ ও ব্যয় বেড়ে গিয়ে করের টাকা অপচয় হয়।
এডিপি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রকল্পগুলোর মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হয়ে যাবে। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় মেয়াদ বৃদ্ধি যথাসময়ে না হওয়ায় অর্থবছরের প্রথম ৪-৫ মাস এসব প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ করা টাকা ছাড় বা ব্যয় করা সম্ভব হয় না। ফলে এডিপির বরাদ্দ কমে যায় এবং সামগ্রিকভাবে এডিপি বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ প্রকল্পগুলোর ৩০ জুনের মধ্যে মেয়াদ বৃদ্ধি বা সংশোধনের সব প্রক্রিয়া শেষ করা প্রয়োজন। যাতে অর্থবছরের শুরুতেই অর্থছাড় বা ব্যয় করা যায়। এজন্য আগামী অর্থবছরের এডিপিতে ‘তারকা’ চিহ্ন দিয়ে রাখা যেতে পারে। তবে বাস্তবায়ন মেয়াদ বৃদ্ধি ছাড়া কোনো প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ অর্থ ছাড় বা ব্যয় করা যাবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলেও সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই। কিংবা এজন্য দায়ী প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসারও কোনো নজির নেই। ফলে এক্ষেত্রে কোনো গুরুত্ব দেন না প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার কারণে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির যে কষাঘাত সেটির জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে বলে মনে করছেন বিষেজ্ঞরা। তারা বলছেন, এটি অবশ্যই পরিকল্পনা ও আর্থিক শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতেও গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৩৯৫টি মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্পের বোঝা চেপেছিল। তখনো এসব প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। কিন্তু এ পর্যন্তই। এর বেশি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া এসব প্রকল্পের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে চলমান প্রকল্পও ছিল। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপিতেও ঘটেছিল এই ঘটনা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের এডিপি থেকে মেয়াদ উত্তীর্ণ প্রায় ৩০০ এর মতো উন্নয়ন প্রকল্প তারকা চিহ্ন দিয়ে যোগ করা হয় এডিপিতে।
আগামী অর্থবছরের এডিপিতে যুক্ত হওয়া মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্পের মধ্যে কয়েকটি হলো-ঘোড়াশাল-৩ রিপাওয়ারিং প্রজেক্ট। এটি ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে এবং আগামী ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা। প্রায় ১০ বছর ধরে চলমান থাকলেও শেষ হওয়ার নাম নেই। এছাড়া ময়মনসিংহ কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের জন্য ধনুয়া হতে ময়মনসিংহ পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ। এটি ২০২২ সালের জুলাই থেকে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে বাস্তবায়নে লক্ষ্য ছিল। আরও আছে, বিআরটির জন্য সিএনজি একতলা এসিবাস সংগ্রহ প্রকল্প ২০২৩ সালে শুরু হয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এতে দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণ রয়েছে। কিন্তু এখনো কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ রোববার বলেন, বিআরটি প্রকল্পের জন্য বাস সংগ্রহ কাজের কিছুই হয়নি এখনো। অথচ অবকাঠামো তৈরির কাজ প্রায় শেষের পথে। কোরিয়া বা যে দেশ থেকে বাসগুলো আনা হবে সেই দেশে বাসের দরজা আমাদের দেশে যেদিকে থাকে তার বিপরীত দিকে থাকে। ফলে বিশেষ অর্ডার দিয়ে আমাদের দেশের মতো উপযোগী করে দরজা তৈরির পর সেগুলো আনতে হবে। কিন্তু এসব প্রক্রিয়া এখনো শুরুই হয়নি।
নড়াইল-কালিয়া জেলা মহাসড়কের ২১তম কিলোমিটারে কালিয়া নামক স্থানে নবগঙ্গা নদীতে কালিয়া সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৭ সালে শুরু হয়ে আগামী জুনে শেষ হওয়া কথা। কিন্তু এখনো এটি সংশোধন বা মেয়াদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সৈয়দপুর-নীলফামারী মহাসড়ক প্রশস্তকরণ ও মজবুতকরণ প্রকল্পটি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলমান। গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ (ময়মনসিংহ জোন) প্রকল্পটি ২০১৭ সালের মার্চ থেকে শুরু হয়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। থানচি-রিমাকরি-মদক-লিকরি সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন মেয়াদ শেষ হয়েছে। একই অবস্থা নলকা-সিরাজগঞ্জ-সয়দাবাদ আঞ্চলিক মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ শহর অংশ ৪ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পেও।
এছাড়া অর্থছাড় ও খরচ স্থগিত হওয়া আরও কয়েকটি প্রকল্প হচ্ছে-সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় লেভেলক্রসিং গেটসমূহের পুনর্বাসন ও মান উন্নীতকরণ এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলের গেটসমূহের পুনর্বাসন ও মান উন্নয়ন প্রকল্প। আরও আছে, রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের জন্য ৫০টি বিজি এবং ৫০টি এমজি যাত্রীবাহী ক্যারেজ নির্মাণ। আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ এবং বিদ্যমান রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরকরণ। রেলওয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন প্রকল্প।